বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ ইউনিট র্যাব প্রভৃতির মতো অপারেশন চালাতে চায় আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। অনেক দিন ধরেই তারা চেষ্টা করছে সংশ্লিষ্ট আইন পরিবর্তন করার জন্য। নানা কারণে তা হয়ে ওঠেনি। ২০১৭ সাল থেকে একটি প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা হয়েছিল। হঠাৎ আনসারের প্রস্তাবের ফাইলটি সচল করা হয়। জাতীয় সংসদে গতকাল সোমবার এ সংক্রান্ত বিল উত্থাপন হয়েছে।
আইনটি কার্যকর করা হলে আনসার সদস্যরা গ্রেপ্তার, মালামাল জব্দ ও মামলার তদন্ত করতে পারবে। কাউকে গ্রেপ্তার করলে থানায় মামলা করতে পারবে। এ নিয়ে পুলিশ ফুঁসছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা রবি ও সোমবার পুলিশ সদর দপ্তরে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। রবিবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। গ্রেপ্তার করা, মালামাল জব্দ ও মামলার তদন্তের বিষয়টি পুলিশের এখতিয়ারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে আইনটির প্রত্যাহার চেয়েছে অ্যাসোসিয়েশন। বিষয়টির সুরাহা করা হবে বলে পুলিশ কর্তাদের আশ্বস্ত করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
২০১৭ সালে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) সদর দপ্তর থেকে আইন পরিবর্তনের জন্য একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্রস্তাবে আইন সংশোধন করে আনসার বাহিনীকে ফৌজদারি অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা দিতে বলা হয়। পুলিশের আপত্তিতে প্রস্তাবটি আটকে ছিল। হঠাৎ সেটি সচল করা হয়েছে। জাতীয় সংসদের বর্তমান অধিবেশনে বিল আকারে এটির উত্থাপন ও পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে আনসারের কয়েকজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান। তবে পুলিশ কর্তারা এ ব্যাপারে নাখোশ। তারা মনে করছেন, এটা তাদের জন্য সুখকর হবে না। বর্তমানে আনসার বাহিনীর সদস্যরা পুলিশের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। এর জন্য তাদের অর্থ দেওয়া হয়। আইনটি নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে।
আনসার ও ভিডিপির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকার যেকোনো সময় যেকোনো অপরাধ তদন্তের জন্য আনসার ব্যাটালিয়নকে নির্দেশ দেবে। সরকারি নির্দেশ জারির পর আনসার ব্যাটালিয়ন কমান্ডিং অফিসাররা অপরাধ তদন্তের দায়িত্ব নেবেন। তারা অপরাধ ও অপরাধসংক্রান্ত কর্মকা-ের তথ্য সংগ্রহ করবে। প্রাধিকারবিহীন অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক, সরকারের নির্দেশে এরূপ বেআইনি বস্তু উদ্ধার করবে। সরকারের নির্দেশই অপরাধের তদন্ত করবে। জঙ্গি, নাশকতাকারী ও জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তার করতে পারবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে জনপ্রশাসনকে সহায়তা করবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে। সরকারের অর্পিত অন্য যেকোনো দায়িত্ব পালন করবে।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, আনসার ও ভিডিপি যুদ্ধকালীন আদেশ কাঠামোর নিয়ন্ত্রণে থেকে অভিযান চালাবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় ও অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রচলিত আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে। আইনের বিধান অনুযায়ী জননিরাপত্তা, অপরাধ প্রতিরোধ, শান্তিরক্ষার নিয়মিত বাহিনী গঠন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে, যা ‘আনসার ব্যাটালিয়ন বাহিনী’ নামে পরিচিত হবে। জননিরাপত্তা বিধানে জরুরি প্রয়োজনে সরকার এ আইনের আওতায় ‘বিশেষায়িত ইউনিট’ গঠন করতে পারবে। আনসার ব্যাটালিয়ন সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শৃঙ্খলা বাহিনী হবে। অবকাঠামোগত বিষয়ে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আনসার বাহিনীর সদর দপ্তর থাকবে ঢাকায়। তাছাড়া ব্যাটালিয়নের জন্য পৃথক সদর দপ্তর হতে পারে। বিভাগীয় সদর দপ্তরে ‘রেঞ্জ সদর দপ্তর’ হবে বা প্রয়োজনে জেলায় বা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রেঞ্জ সদর দপ্তর হতে পারে। সরকার নীতিমালা বা আইন প্রণয়ন করলে আনসার সদস্যরা অস্ত্র, গোলাবারুদ বহন ও ব্যবহার করতে পারবে।
পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন আপত্তি করেছে, উল্লিখিত ধারাগুলোর প্রয়োজনীয়তা নেই। বিষয়টি ফৌজদারি কার্যবিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী আটক, তল্লাশি ও জব্দ তালিকা করতে পারেন সাব-ইন্সপেক্টরের নিচের কোনো পুলিশ কর্মকর্তা। বিচারের ক্ষেত্রে পুলিশের প্রস্তুত করা জব্দ তালিকাই আদালতে গ্রহণযোগ্য। তল্লাশি ও আলামত জব্দ করা তদন্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুলিশ কর্মকর্তারা এসব কাজের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত। নতুন করে কাউকে আটক করার ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী আনসার ব্যাটালিয়ন জব্দ তালিকা প্রস্তুত, তল্লাশি ও গৃহে প্রবেশের এখতিয়ার পেলে আইনি জটিলতা তৈরি হবে এবং তদন্তসহ বিচারকাজ ব্যাহত হবে। অ্যাসোসিয়েশন আরও বলছে, ‘ব্যাটালিয়ন আনসারের ম্যান্ডেট হচ্ছে তারা একটি সহায়ক বাহিনী। সহাধিকারক্ষেত্রে আটক, তল্লাশি, জব্দ ও জব্দ তালিকা প্রস্তুত অপরাধ দমন ও উদঘাটনের ধারাবাহিক কার্যক্রম বা ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অবশ্যই পুলিশ ক্ষমতাপ্রাপ্ত। একই ক্ষেত্রে আনসার ব্যাটালিয়নকে কর্তৃত্ব দেওয়া হলে আইনি জটিলতা তৈরি হবে। একাধিক বাহিনীকে সহাধিকারক্ষেত্র দেওয়া হলে আইন প্রয়োগকালে ভুল বোঝাবুঝি ও মতভেদসহ নানা সমস্যা তৈরি হবে।
এ প্রসঙ্গে আনসারের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রায় ছয় বছর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইন সংশোধন চেয়ে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। মন্ত্রণালয় থেকে বেশ কিছু শর্ত ও পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। সংশোধন ও সংযোজন করে আবার তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কোনো আইন বা বিধি পাস হওয়ার আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে সেটি যায়। এ প্রস্তাবের ক্ষেত্রে আমরা সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছি। যতদূর জানি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রস্তাবটি বিল আকারে ওঠার কথা রয়েছে। সংসদে বিল পাস হলে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবে আনসার ও ভিডিপি।’
তিনি বলেন, ‘আইনটি পুলিশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না। আমরা র্যাবের মতোই কাজ করতে পারব। অপারেশন চালাতে পারব। পুলিশ কেন এর বিরোধিতা করছে বুঝতে পারছি না। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সুশৃঙ্খল বাহিনী হচ্ছে আনসার। কোন এলাকায় কারা মাদক কারবার করে, কারা আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি, কারা জঙ্গি ও উগ্রবাদী তৎপরতায় জড়িত, কারা কালোবাজারি, চাঁদাবাজি বা বেআইনি কাজে জড়িত তার তথ্য আনসার বাহিনীর কাছে আছে। আনসার ও ভিডিপি ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পেলে আইনশৃঙ্খলার রক্ষা করা সহজ হবে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আনসারের প্রস্তাবিত আইনটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য সবাই মিলেমিশে কাজ করছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রচলিত আইনে আনসার বাহিনী কাউকে গ্রেপ্তার বা মামলার তদন্ত করার এখতিয়ার রাখে না। তারা পুলিশের সহযোগী। পুলিশের চাহিদার আলোকে বিভিন্ন ইউনিটের সঙ্গে সহযোগী ফোর্স হিসেবে তারা মোতায়েন থাকে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আনসার গ্রেপ্তার, তদন্ত ও মালামাল জব্দ করার ক্ষমতা পেলে তা হবে আত্মঘাতী। পুলিশ রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে। আনসারও একই কাজ করে। তবে পুলিশের মতো কাজ করার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। র্যাব বা অন্য ইউনিট যেভাবে অপারেশন চালায়, তার ধারেকাছেও যেতে পারবে না আনসার। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব বিষয়টির সমাধানে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।’ তারা বলেন, ‘আনসার বাহিনীর ক্ষমতা বাড়লে তা পুলিশের জন্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একটি মহল চায় পুলিশ যেন ভালো কাজ করতে না পারে। আনসার যদি সত্যি সত্যি পুলিশ হতে চায়, তাহলে বাহিনীটিকে পুলিশের সঙ্গে মার্জ (সংযুক্ত) করে দিলেই হয়।’
সুত্র- দেশ রূপান্তর।